ঢাকা, ০৮ সেপ্টেম্বর রোববার, ২০২৪ || ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
good-food
৩৪৪

আম রপ্তানি ও বাজার বাড়াতে অঞ্চলভিত্তিক প্যাকিং হাউজসহ ৮ দাবি 

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:১৪ ২৭ মে ২০২৪  

আমের বাজার সম্প্রসারণ এবং রপ্তানি বাড়াতে ৮ দফা দাবি জানিয়েছেন চাষি, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক ও গবেষকরা। রপ্তানির পথ সুগম করতে অঞ্চলভিত্তিক প্যাকিং হাউজ তৈরির তাগিদ দিয়েছেন তারা। তাদের দাবি, মিডিয়ায় কিছু ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত খবর প্রচারের কারণে আম ব্যবসায়ী ও চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

 

সোমবার (২৭ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে 'বাংলাদেশে আম উৎপাদন: সমস্যা ও সম্ভাবনা' শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (সিজেএফডি), ঢাকা এটি আয়োজন করে।

 

রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার সীমিত রেখে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে আম উৎপাদন, প্যাকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিবহনের জন্য আধুনিক যানবাহনের ব্যবস্থা, বিমানের কার্গোতে পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজতর করা, রপ্তানি উপযোগী আমের চাষ সম্প্রসারণ, চাষি বিশেষ করে রপ্তানির জন্য উৎপাদনকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, আম থেকে উৎপাদিত পণ্য যেমন- জুস, জ্যাম, জেলি, আচার, ক্যান্ডি, ম্যাংগো পাউডার ইত্যাদির বাজার সম্প্রসারণ, আমভিত্তিক শিল্প স্থাপনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, জৈব প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদন উৎসাহিত করা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্যাকিং ও পরিবহন বিষয়ে প্রশিক্ষণ, রপ্তানিকারকদের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং মানদণ্ড ঠিক করে দেয়ার ওপর গুরুত্ব দেন আলোচকরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম, ঢাকা (সিজেএফডি) সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মু. জিয়াউর রহমান এমপি, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এমপি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, পুলিশের ঢাকা রেন্জের ডিআইজি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতি, ঢাকার সভাপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ এগ্রো-কেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি  কে এস এম মুস্তাফিজুর রহমানসহ বিশেষজ্ঞরা। 

 

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. গোলাম রাব্বানী। প্রধান আলোচক ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেসুর রহমান। 


সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য  রাখেন সিজেএফডি'র  সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক সবুজ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিজেএফডি'র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক আনোয়ার হক। সেমিনারে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, চাষিসহ কৃষিখাত সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা উপস্থিত থেকে তাদের মতামত তুলে ধরেন। 


মো. শাহরিয়ার আলম এমপি বলেন, রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতেই আমের চাষ বেশি হয়। জীবন জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন তা হচ্ছে। বর্তমানে নওগাঁ জেলায় আমের ব্যাপক চাষ হচ্ছে। চাষি ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে ২০০৯ সালে সমিতি করি। আমার নির্বাচনী এলাকায় ধান নেই বললেই চলে। সব স্থানেই আমের বাগান। সবার অর্থনীতি আম চাষের ওপর নির্ভর করে। 

 

তিনি বলেন, ২০২১ সালের দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে সিলেট, চট্টগ্রামে বিভিন্ন গাড়িতে আম যেতো। তখন ফরমালিনের কথা বলে তা নষ্ট করে দেয়া হতো। এ থেকেই বাংলাদেশের মানুষের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর আম অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি  হয়। ফরমালিন ব্যবহার নিয়ে মিডিয়া কর্মীরা অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করার কারণেই রাজশাহী অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পরবর্তীতে আমি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলি,  রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ আমে ফরমালিন ব্যবহার করেন না। 

 

সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, ফলের জন্য পূর্বে শ্যামপুরে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার ছিল মাত্র একটি।  কিন্তু সেটিও বন্ধ রয়েছে, যা সাবেক সরকারের কৃষিমন্ত্রী সফর করে দেখেছেন। আমি কৃষিমন্ত্রীকে আহ্বান করার পর দেশের চারটি স্থানে কোয়ারেন্টাইন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এগুলোর কাজ চলমান রয়েছে। কোয়ারেন্টাইনগুলো  স্থাপিত হলে ওই অঞ্চলের ফল ব্যবসায়ীরা ব্যাপক উপকৃত হবেন। 

শাহরিয়ার আলম বলেন, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বের প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের আম রপ্তানি হয়েছে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর কারণে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের 'গ্যাপ'র নিয়ম অনুসারে আম চাষ করতে হবে। তবেই বিদেশে রপ্তানি করা যাবে।

 

তিনি বলেন, জাপানের মানুষ বাংলাদেশি আমের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। সেদিন বেশি দূরে নয় যেখানে জাপানি আমের মতো বাংলাদেশের ন্যাংড়া নিলামে উঠবে। বাংলাদেশের আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তাই রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব শর্ত থাকা প্রয়োজন, সেগুলো মেনে আমাদেরকে আম চাষে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। 

 

মু. জিয়াউর রহমান এমপি বলেন, আমের দেশের মানুষ আমি। আমাদের আম চাষের সমস্যা অনেক। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। আম সারাদেশেই হয়। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেক উন্নত ও সুস্বাদু। তাই চাষের জন্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

ডিআইজি নুরুল ইসলাম বলেন, জন্মের পর থেকে আমগাছ দেখেছি। বুদ্ধি হওয়ার পর আমের মুকুল দেখেছি। আমাদের এলাকার মানুষের জীবন জীবিকার প্রধানতম উৎস আম চাষ। আমরা বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের কাছে ভালো মানের আম পৌঁছে দিতে চাই। আম চাষ লাভজনক না হলে এক সময় আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাবে।

 

তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হতে মূলত দেশজুড়ে আম চাষের বিস্তার ঘটেছে। আমাদের সবার দায়িত্ব চাষের পরিধি বৃদ্ধি করে এর বিস্তার ধরে রাখা। আমাদের চিন্তা করতে হবে আম চাষ কিভাবে করে লাভজনক করা যায়। আমরা বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী পৌঁছে দিতে পারছি না। এ ব্যাপারে আমাদের আরো জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। আমের সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। 

ডিআইজি বলেন, আমরা থাইল্যান্ড থেকে আমজাত মজাদার পণ্য খেয়ে থাকি। কিন্তু বাংলাদেশেই ভালো মানের আমজাত নানা পণ্যের উৎপাদন ও প্যাকেজিং ব্যবস্থা থাকলে আমদানি করতে হবে না। আমাদের আম প্যাকেজিং সিস্টেম উন্নত করতে হবে। আম চাষিরা অনেকেই বলেন, আম খাতে ভর্তুকি দিতে হবে। এটা ভুল, কারণ সরকারের ভর্তুকি দেয়ার আরো অনেক খাত রয়েছে। চাষ লাভজনক করতে সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে ভালো মানের আম দেশের অলিতে গলিতে পৌঁছে দিতে হবে। আম বিদেশে রপ্তানি করতে হবে না। কারণ আমের চাহিদা বাংলাদেশেই ব্যাপক রয়েছে। 

 

আম শিল্পে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ অন্যতম আম উৎপাদক দেশ। আবহাওয়া ও মাটি অনুকুল। মৌসুম মে - সেপ্টেম্বর, পিক জুন - জুলাই। উৎপাদন এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, সাতক্ষীরা সহ সারাদেশ।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে আম চাষের এরিয়া ও ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

আমের উন্নত  জাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গোপালভোগ, খিরসাপাত, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলী, আশ্বিনা, বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি আম-১১, বারি আম-১২ ইত্যাদি। তারা বলেন, পুরনো বয়স্ক বাগানে আম উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপন্ন হয়। কিন্তু যথাযথ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩০-৪০%। 

 

বক্তারা বলেন, পিক মৌসুমে উৎপাদন প্রাচুর্যে মূল্য হ্রাস পায়, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। জিএপি অনুসরণে নিরাপদ ও চুক্তিবদ্ধ উৎপাদন নেই। সরকারী উদ্যোগে রফতানি ও বাজার সহায়ক স্পেশাল ট্রেন চালুর ব্যবস্থা করেছেন। ভিএইচটি সহ আরো কিছু বিষয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে।

আলোচকরা বলেন, আমের আঁটি থেকে উৎপাদিত তেল দিয়ে দেশের বার্ষিক ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার ৪ শতাংশ মেটানো সম্ভব।


তারা জানান, পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে ২৫-২৭ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়। গবেষণার মাধ্যমে এসব আমের আঁটি থেকে ভোজ্যতেলের উৎপাদন করা সম্ভব।

 

রপ্তানির বিরাজমান সমস্যাগুলো তুলে ধরেন বক্তারা। বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর মাধ্যমে 'উত্তম কৃষি চর্চা' (GAP) অনুসরণপূর্বক রপ্তানিযোগ্য নিরাপদ আম উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশে আম উপাদন ও উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমদানিকারক দেশ কর্তৃক আরোপিত বিভিন্ন শর্তাবলী পূরণ না করা, রপ্তানিযোগ্য উন্নতমানের আম উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে ভ্যালুচেইনের সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষক, গবেষক, সম্প্রসারণকর্মী, কোয়ারেন্টাইন বিভাগ ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের অভাব, গাছ থেকে আম সংগ্রহের উপযুক্ত পরিপক্কতা পর্যায় (Optimum harvest maturity) নির্ধারন ও সংগ্রহোত্তর উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের যথোপযুক্ত জ্ঞান, দক্ষতা এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার জন্য দেশের প্রধান প্রধান উৎপাদন এলাকায় অদ্যাবধি মানসম্মত হিমাগার ও প্যাকহাউজ গড়ে না ওঠা, সংগ্রহের পর আমের গুণগত মান বজায় রেখে যথাযথভাবে গ্রেডিং, প্যাকিং করে কুলিং ভ্যানের মাধ্যমে আর পরিবহণ না করা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন রপ্তানি বাজার সৃষ্টি করতে না পারা এবং উন্নতমানের নিরাপদ আম রপ্তানির জন্য রপ্তানিকারকদের অনীহা ও মানসিকতা তৈরি না হওয়া, আমে উপস্থিত পেস্টিসাইডের রেসিডিও অ্যানালাইসিস ও ফলের গুণমান পরীক্ষার জন্য পূর্ণ সক্ষমতা সম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবরেটরির অভাব, আমের উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষ করে কোয়ারেন্টাইন পেস্ট যেমন, ফ্রুট ফ্লাই, অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পচা রোগ (Stem end rot) ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্টসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো ও উন্নত প্রযুক্তির অভাব, উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে ফসলে ব্যবহৃত যাবতীয় উপকরণ ও কার্যক্রম ফার্ম রেকর্ড বইয়ে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ না করা ইত্যাদি সমস্যা বিরাজমান। এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।